ঢাকা, শুক্রবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৪ ১৪৩১

ইরানের মাটিতে যত ‘গোপন অপারেশন’ চালিয়েছে ইসরায়েল

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

ইরানের মাটিতে যত ‘গোপন অপারেশন’ চালিয়েছে ইসরায়েল

ইরানের মাটিতে যত ‘গোপন অপারেশন’ চালিয়েছে ইসরায়েল

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ের হত্যার পরেই অভিযোগের তীর উঠেছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ইরান সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলকে ‘কঠিন শাস্তি’ দেওয়ার হুমকিও দেয়। ইসরায়েলের তরফে সরাসরি কোনো বক্তব্য না এলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে তার দেশ সাম্প্রতিক সময়ে তার ‘শত্রু’দের চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার মতো আঘাত হেনেছে।

অবশ্য এই প্রথম নয়, এর আগে বহুবার এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের অভ্যন্তরে মোসাদ কোন পর্যায়ের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এবং গত কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আন্দাজ পাওয়া যায় যে ইরানে অতি উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদেরও তারা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট অপারেশন চালানোর জন্য।

ইসরায়েলের সেই সব অপারেশনের মধ্যে যেমন রয়েছে গুপ্তহত্যা, তেমনই রয়েছে সাইবার আক্রমণ এবং ড্রোন দিয়ে হামলা। মোসাদের গোপন অভিযানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত শীর্ষ বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। ইরানের অভিযোগ, মোসাদ ইরানের বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা, এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে।

ইরানে গুপ্ত হত্যা ও সাইবার হামলা

২০১০ সালের জানুয়ারিতে তেহরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদ-আলি-মোহাম্মদী একটি মোটরসাইকেলে রাখা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। এ ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। একইভাবে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক প্রকৌশলী মাজিদ শাহরিয়ারি কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একটি গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। আহত হন তার স্ত্রীও। তৎকালীন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ওই হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত থাকার অভিযোগ করা হয়।

তেহরানের বাইরে গাড়ি চেপে যাওয়ার সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ। পশ্চিমা দেশগুলি এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করতেন যে ফাখরিজাদেহ ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক। জাতিসংঘ ২০০৭ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে তার ওপরে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল।

ইরানের ধারণা, শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে গুলি করে হত্যা করতে ইসরায়েল ও নির্বাসিত বিরোধী গোষ্ঠী রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসি-র কর্নেল হাসান সায়াদ খোদাইকে তেহরানে তার বাড়ির বাইরে পাঁচবার গুলি করে খুন করা হয়। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মাজিদ মিরাহমাদি ওই হত্যাকাণ্ডকে 'নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েলের কাজ' বলে অভিহিত করেছিলেন। কর্নেল খোদাই আইআরজিসি-র বিদেশ অভিযান শাখা - কুদস ফোর্সের সদস্য ছিলেন বলে জানিয়েছে তারা।

প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ওই হত্যাকাণ্ডের পিছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে 'বৈশ্বিক ঔদ্ধত্য'কে দায়ী করেছেন।

সাইবার হামলা

ইরানের বুশেহর শহরের পারমাণবিক কেন্দ্রের কম্পিউটারে স্টাক্সনেট ভাইরাস পাওয়া যায় এবং তা সেখান থেকে অন্যান্য প্রকল্পে ছড়িয়ে পড়ে।

ইরানের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদের ব্যক্তিগত কম্পিউটারগুলি একটি জটিল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা ইরনা। তবে বুশেহর প্ল্যান্টের অপারেটিং সিস্টেমের কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সেখানকার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহমুদ জাফারি। স্টাক্সনেট ভাইরাস একটি শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভাইরাসটি এতই জটিল যে এটি কেবল কোনো 'জাতিরাষ্ট্র'-ই বানিয়ে থাকতে পারে। সে বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১৪ টি প্রকল্পের প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল।

ইরান ঘোষণা করে যে ফ্লেম নামে একটি ভাইরাস ব্যবহার করে সরকারি কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

বিবিসির ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদনে এই ফ্লেম ভাইরাসটি নিয়ে লেখা হয়েছিল। সাইবার-নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাস্পারেস্কি ল্যাবস্-কে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছিল যে ফ্লেম ভাইরাসটি এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব থেকে জটিল ভাইরাস। ক্যাস্পারেস্কি এটাও বলেছিল যে তারা মনে করে এই ভাইরাস আক্রমণ কোনও রাষ্ট্রই চালিয়েছে, তবে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।

ইরানের নাগরিকরা ভর্তুকি হারে জ্বালানি কেনার জন্য যে সরকারি কার্ড ব্যবহার করেন, তার ব্যবস্থাপনাতেই সাইবার হানা হয়। দেশের ৪,৩০০টি পেট্রোল স্টেশনই এর ফলে প্রভাবিত হয়। গ্রাহকদের হয় নিয়মিত দামে জ্বালানি কিনতে হয়েছিল যা ভর্তুকি-যুক্ত দামের দ্বিগুণেরও বেশি, অথবা কেন্দ্রীয় বিতরণ ব্যবস্থাপনায় স্টেশনগুলি যতক্ষণ না আবারো সংযোগ করতে পারে, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই ঘটনার জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিল ইরান।

ইরানের দক্ষিণ উপকূলে শহীদ রাজাই বন্দরে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার ব্যবস্থাপনায় সাইবার হানা হয়। ওই সাইবার হামলার ফলে বন্দরে আসার জন্য জাহাজগুলিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্ট এই খবরটি দিয়ে জানিয়েছিল যে ওই হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। তবে ইসরায়েল ওই সাইবার হামলার দায় স্বীকার করে নি।

 সাইবার আক্রমণ ও ড্রোন হামলা

ইসরায়েল শুধু হত্যাকাণ্ডেই থেমে থাকেনি, ইরানে একাধিক সাইবার আক্রমণের পেছনেও তাদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০১০ সালে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে স্টাক্সনেট ভাইরাস আক্রমণ করে বিশাল ক্ষতি সাধন করে। ২০২১ সালে ইরানের জ্বালানি ব্যবস্থা এবং ২০২২ সালে সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়ও সাইবার হামলা চালানো হয়।

২০২৪ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় সাতজন নিহত হন। এর প্রতিশোধে ইরান ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।

এই সব ঘটনার পেছনে ইসরায়েলে উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা এবং তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে আনা।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়