সবুজে ঘেরা শেরপুরের রাজার পাহাড়

4

‘রাজার পাহাড়’ নামটি শুনলেই কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি হয়। মনে নানা প্রশ্ন জাগে, রাজার পাহাড়ে কি রাজা থাকেন? প্রাচীনকালে এখানে এক স্বাধীন রাজা ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী ছিলেন। তার নামানুসারেই এ পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে রাজার পাহাড়। পাহাড়টি শেরপুর শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া বাজার সংলগ্ন ঢেউফা নদীর তীরে অবস্থিত। গারো পাহাড়ে যতগুলো পাহাড় আছে; তার মধ্যে রাজার পাহাড়ের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। এখানে ভ্রমণে গেলে আকাশ ছোঁয়া বিশাল পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য আপনার মনকে আরও প্রকৃতিপ্রেমী করে তুলবে।

বাংলাদেশের অন্য পাহাড়ের তুলনায় এ পাহাড়ে সবুজের ঐশ্বর্য কোনো অংশেই কম নয়। পাহাড়ে যেতেই চোখে পড়বে উঁচু-নিচু টিলা। এ টিলা দিয়ে নেমে নিচে রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় সমতল ভূমি। সমতল ভূমিতে উঠলেই মনে হবে, আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজার পাহাড় আসলেই গারো পাহাড়শ্রেণির মধ্যে এক রাজা। বিশাল সমতল ভূমিতে যেতে সরু পথ আর অদ্ভুত নির্জনতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ওই পথে যেতে যেতে পথের দু’ধারে চোখে পড়বে সবুজ লতা-পাতা, গুল্ম, বিভিন্ন ওষুধি গাছ ঝুপড়ি বেঁধে আছে। গাছগুলোর ভেতরে ছোট ছোট পাখির বাসা। যাদের কলতানে চারদিক মুখরিত। তখন অনায়াসে মনে একটি প্রশান্তি দোলা দিয়ে যাবে।

স্থানীয়দের কাছে পাহাড়টি অনেক জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্র। এ সম্ভাবনায় পাহাড়টিকে দর্শনার্থী নিয়ে আসতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়টিতে শীত মৌসুমে কিছু দর্শনার্থী চোখে পড়লেও বাকি সময় দর্শকশূন্য হয়ে পড়ে থাকে। তবে সমতলের চূড়ায় গেলে দেখা মিলবে কিছু লোকজনের। যারা সেখানে মাল্টা, লেবু, করলা, মরিচ, চিচিঙ্গা, পেঁপে, জলপাইসহ অনেক শাক-সবজি ও ফল-মূল চাষ করেছেন। কেউবা সমতলের বিশাল জায়গায় গবাদিপশু চড়াচ্ছেন। একদমই নিরিবিলি পরিবেশ, মনকে সহজেই প্রশান্তি এনে দেয়।

রাজার পাহাড়ের চূড়া থেকে মেঘালয় যেন আরও কাছে মনে হয়। এর চূড়া সবুজ আর নীলের সংমিশ্রণে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আকাশ ছোঁয়া বিশাল পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য। এটি মনকে করে আবেগতাড়িত। গোটা পাহাড় যেন বিছানা পেতে বসে আছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে প্রকৃতিপ্রেমীকে।

পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় আশপাশের কর্ণঝোড়া, মালাকোচা, দিঘলাকোনা, হারিয়াকোনা, চান্দাপাড়া, বাবোলাকোনাসহ ভারতের সীমান্ত এলাকা। পাহাড়ের নিচ দিয়েই কুলকুল শব্দে বয়ে চলছে ঢেউফা নদী। বর্ষাকালে ঢেউফা নদীর জোয়ারে কানায় কানায় ভরে ওঠে। দিনের শেষে ভাটা পড়ে। শুকিয়ে যায় নদীর পানি। খরস্রোতা এ নদীর গতি কখনো থামে না। সারাবছরই হেঁটে পার হওয়া যায়। কয়েক বছর ধরে নদীর দু’পাশে সেতু নির্মিত হওয়ায় এখন আর নদীতে থামতে হয় না। বুকজুড়ে বিশাল বালুচর, যা নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য শহরে নিয়ে যাচ্ছে। এ যেন রাজার পাহাড় থেকে বাবেলাকোনা কূলঘেঁষা বিকল্প সমুদ্রসৈকত।

রাজার পাহাড়ঘেঁষা জনপদ বাবেলাকোনা। এখানে অসংখ্য উঁচু-নিচু টিলায় ঘেরা অনবদ্য গ্রাম। প্রাচীনকাল থেকে এখানে গড়ে উঠেছে জনবসতি। ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত গ্রামটি কালের আবর্তে পরিবর্তিত। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত সবার কাছে পরিচিত রাজার পাহাড় থেকে বাবেলাকোনা। বাবেলাকোনায় গারো, হাজং, কোচ অধ্যুষিত উপজাতিদের সংস্কৃতি ভিন্ন মাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা। যেন প্রাকৃতিক বিরূপতা। এ যেন জঙ্গল আর জন্তু-জানোয়ারের নৈসর্গিক মিতালি। জনপদটির চলমান জীবন সংগ্রামের বিরল দৃশ্য। উপজাতিদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চার কেন্দ্রগুলোও যেন আলাদা আকর্ষণ। এসব হচ্ছে বাবেলাকেনা কালচারাল একাডেমি, ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, জাদুঘর, লাইব্রেরি, গবেষণা বিভাগ, মিলনায়তন অন্যতম নিদর্শন। এখান থেকে উপজাতিদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়। মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হচ্ছে এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গ্রাম্য বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জীবনধারা আরও মুগ্ধ করবে। এ ছাড়া পাহাড়ের কাছে আছে বিডিআর ক্যাম্প, ওয়ার্ল্ড ভিশন, বিট অফিস, কারিতাস এবং রাবার বাগান।

রাজা পাহাড়ের যাতায়াতব্যবস্থা অনেক ভালো। ঢাকার মহাখালী থেকে কর্ণঝোড়া বাজার পর্যন্ত প্রতিদিন দুটি বাস যাতায়াত করে। একটি হলো সোনার বাংলা। এটি ঢাকার মহাখালী থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় ছাড়ে। কর্ণঝোড়া বাজার থেকে ছাড়ে রাত ১০টায়। বাসের ভাড়া ৫০০ টাকা। অন্যদিকে এসজিএস জয়িতা নামের বাসটি কর্ণঝোড়া বাজার থেকে মহাখালী যায় প্রতিদিন সকাল ৮টায় আর রাতে যায় পৌণে ৯টায়। ভাড়া ৫০০ টাকা। এ ছাড়া দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে রাজার পাহাড়ে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে শেরপুরের সড়ক যোগাযোগ খুবই ভালো। ঢাকার মহাখালী থেকে সোনার বাংলা, সাদিকা, শেরপুর টেনিস ক্লাব পরিবহনসহ অনেক এসি ও নন-এসি বাসে শেরপুর যেতে হবে। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দুপুর ২টায় শেরপুর যাওয়ার এসি বাস ছাড়ে। ভাড়া বাস অনুযায়ী ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হতে পারে।

শেরপুর শহর থেকে রাজার পাহাড়ে যেতে প্রথমে খোয়ারপাড় থেকে সিএনজি করে ৫০ টাকায় শ্রীবরদী, এরপর শ্রীবরদী থেকে অটো করে ৪০ টাকা ভাড়ায় কর্ণঝোড়া বাজার। বাজারে নেমে উত্তরদিকে গুচ্ছগ্রাম, এখান থেকে হেঁটেও যাওয়া যায় খুব সহজে। এর জন্য নদীর একটা ছররা পার হতে হয়। ছররা পার হতে না চাইলে আপনাকে বাজার থেকে ভ্যানে ১০ টাকায় যেতে হবে মেঘাদল বাজার। যেটি ‘শয়তান বাজার’ নামে পরিচিত। এ বাজার থেকে পূর্বদিকে রাজার পাহাড়। ভ্যানে করে ১ কিলোমিটার ১০ টাকায় পৌঁছে যাবেন। পাহাড়ের ভেতরে নামতে চাইলে ভাড়া নেবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। যাওয়ার পথেই পড়বে কর্ণঝোড়া সেতু। সেতুর পাশেই বিট অফিস। এরপরেই রাস্তার দু’ধারে তাকালেই চোখে পড়বে পাহাড়। রাজার পাহাড় ঘোরা শেষ করে আবার ‘শয়তান বাজার’ থেকে হাতের উত্তরদিকে ২ কিলোমিটার বাবেলাকোনা গ্রাম। ভ্যান ভাড়া ১০ টাকা। পশ্চিমদিকে ৩ কিলোমিটার দূরে লাউয়াচাপড়া পর্যটনকেন্দ্র। ভ্যান ভাড়া ১০ টাকা।

রাত কাটানোর জন্য রাজার পাহাড় থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো বন বিভাগের ডাকবাংলো। তাছাড়া যে কেউ থাকতে পারেন লাউয়াচাপড়ার পিকনিক স্পটের কাছে বনফুল রিসোর্টে। তবে এ ক্ষেত্রে খরচ হবে ৩০০০-৫০০০ টাকা। শ্রীবরদী উপজেলার ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন কম খরচে। যদিও আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে। জেলা সদরে আছে জেলা পরিষদ এবং এলজিইডির রেস্ট হাউজ এবং জেলা ডাকবাংলো। এ ছাড়া শেরপুর জেলা শহরে হোটেল সম্পদ, হোটেল কায়সার ইন ছাড়াও কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে, যেখানে নিশ্চিন্তে রাত কাটানো যাবে।

খাবারের জন্য শেরপুর শহরে চলে আসা সবচেয়ে ভালো। নিউমার্কেট এলাকায় হোটেল শাহজাহান, হোটেল স্টার, হোটেল আহার ও হোটেল প্রিন্সে যেতে পারেন। এখানে খেয়ে আসতে পারেন দুধের ছানা, ছানার পায়েস। কারণ এটা এ অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার। এরই মধ্যে শেরপুরের ছানার পায়েস বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শহরের অনুরাধা, চারু মিষ্টান্ন সুইটস, নন্দ গোপালের ছানার পায়েস খুবই জনপ্রিয়।

রাজার পাহাড় শুধু পাহাড় নয়; প্রকৃতি-সংস্কৃতি আর ইতিহাসের মায়াময় বন্ধন। একদিনেই পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে যেতে পারবেন। যদি রাত কাটান তাহলে সময় করে কাছাকাছি লাউয়াচাপড়া, গজনী অবকাশ, মধুটিলা ইকোপার্ক, নাকুগাঁও স্থলবন্দর, পানিহাটা তারানি পাহাড়গুলোও ঘুরে যেতে পারেন। প্রত্যেকটি পাহাড়ে যাওয়ার যাতায়াতব্যবস্থা অনেক ভালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here